Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
ময়মনসিংহ এর ইতিহাস ....!!
ছবি
ডাউনলোড

আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। আসাম উপসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে মধুপুর-ভাওয়ালের বিশাল বনভূমির প্রান্তভাগে। লৌহিত্য নামের এক দুরন্ত নদীর জলরাশির সাথে পলি ভেসে আসছে সুদূর হিমালয় থেকে। পলি আসছে সুরমা-ধনু-মেঘনা-সোমেশ্বরী দিয়ে। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে বেলে-দোয়াশ-এঁটেল মাটির সংমিশ্রণে বৃহত্তর ময়মনসিংহের অপূর্ব ভূ-ভাগ।

বর্তমান ব্রহ্মপুত্রের আদি নাম-ই লৌহিত্য। এই নাম হতে পারে ইতিহাসের কোনো বিশেষ চিহ্নের জন্য। অথবা লাল পলি বহন করা বা লোহিত-রং মাটিতে প্রবাহিত হওয়া কিংবা গেরুয়া মাটির বনাঞ্চলে বাধা পেয়ে লৌহিত্য সাগর হয়ে ওঠার জন্য। এরপর এর নাম ব্রহ্মপুত্র হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে বৈদিক যুগের সুস্পষ্ট আর্য প্রভাব। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী পরশুরামের কঠোর কুঠার ব্রহ্মকুণ্ডে অবগাহনেই হাত থেকে স্খলিত হয় বলে তিনি এই পুণ্য বারিধারাকে সমতলে প্রবাহিত করেন। অথবা ব্রহ্মা জনহিতার্থে তার পুত্রকে উৎসর্গ করেন বলে হয়তো এ নদের নাম ব্রহ্মপুত্র।

সুদীর্ঘ পাঁচ হাজার বছর পূর্বমুখী হয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্রের প্রায় দুই শ কিলোমিটার দীর্ঘ ধারা আর গড়ভূমিতে বাধা পেয়ে ঊর্বর পলিমাটিতে গড়ে তুলেছে আদি ময়মনসিংহকে। তবে উপর্যুপরি বন্যার পলি জমে আর আঠার শতকের শেষদিকের ভয়াবহ ভূমিকম্পে এর গতিপথে ঘটল ব্যাপক পরিবর্তন। গঙ্গার তিনগুণ প্রায় দশ মাইল প্রশস্ত হয়ে এই নদ সোজা দক্ষিণে যমুনা খাত বেয়ে বইতে লাগলো, যা পাড়ি দিতে গুণতে হতো দশ কাহন কড়ি। আর এদিকে সেই পলির প্রাবল্যেই বর্তমানে আদি ব্রহ্মপুত্র মৃতপ্রায়।

তবে অতীতে এই পলির ঊর্বরতাই আকৃষ্ট করেছে ভাগ্যান্বেষীদের। জেগে ওঠা এই ব-দ্বীপে বসতি স্থাপন করেছে নিগ্রোটোদ্রাবিড় রক্তমিশ্রিত অষ্ট্রিক-মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন সময়ে কামরূপ, পাটালীপুত্র বা পুণ্ড্রবর্ধনের অধীনে থেকে বিকশিত হয়েছে এর অষ্ট্রো-দ্রাবিড় মিশ্রিত আর্যভাষার একটি বিশেষ রূপাশ্রিত ভাষা। আর্য প্রভাবকে স্বীকার করে বহিরাগতদের সাথে মিলেমিশে ধর্মবোধ ও ভাষাগত ঐক্যের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের বিচিত্র জনসমাজ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ময়মনসিংহ নামে এক বিচিত্র জনপদ।

মূলত পশ্চিম ময়মনসিংহে ক্রমবর্ধমান ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে যে ব্যাপক অরাজকতার তাণ্ডব ক্রমশ অন্যান্য অঞ্চলেও সংক্রমিত হচ্ছিল তা প্রশমণের জন্যেই ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে ‘নাসিরাবাদ’ নামে এ জেলার পত্তন ঘটে। মিঃ ডব্লিউ রটন নিযুক্ত হন প্রথম কালেক্টর। তবে এরও আগে বেগুনবাড়ির কাছে বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসির উদ্দিন নসরৎ শাহ প্রতিষ্ঠা করেন নাসিরাবাদ শহর যা গ্রাস করে করাল ব্রম্মপুত্র। ১৭৯১ সালে তাই সেহড়া মৌজায় পত্তন ঘটে জেলা সদরের। ১৮৬৯-এ পৌরসভাও প্রতিষ্ঠিত হয় নাসিরাবাদ নামেই। এরপর ধীরে ধীরে ময়মনসিংহ নামের প্রতিষ্ঠা ঘটে আর নাসিরাবাদ নামটি বিলুপ্ত হয়ে শুধু স্মৃতি হিসেবে টিঁকে থাকে কতিপয় প্রতিষ্ঠানের নামে।

তবে এ অঞ্চলের ৩৯টি পরগণার মধ্যে নামকরণের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহকে বেছে নেওয়ার কারণ সম্ভবত এটি বৃহৎ পরগণা এবং এর জমিদারদের অধিক রাজস্ব প্রদানের স্বীকৃতি। কিন্তু প্রশাসক ও সিদ্ধপুরুষ মোমেন শাহের নামে মোমেনশাহী এবং তা থেকে কালক্রমে ময়মনসিংহ নামের উদ্ভব বলে যে ইতিহাস প্রচলিত তার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। বরং মমিনসাহী পরগণার ‘মমিন’ এবং সিংনছরৎওজিয়ালের ‘সিং’ মিলেই সৃষ্টি হয়েছে মমিনসিং এবং তা থেকেই পরবর্তীতে এসেছে ময়মনসিংহ নাম।

ক্রমাগত বিদ্রোহ ও আন্দোলনের ব্যাপকতায় প্রশাসনিক কারণে এরপর এ জেলায় স্থাপিত হয় অস্থায়ী সেনানিবাস, পুলিশ ফাঁড়ি বা থানা এবং ৪টি মহকুমা। জামালপুর ১৮৪৫-এ, কিশোরগঞ্জ ১৮৬০-এ, টাঙ্গাইল ১৮৬৯-এ ও ১৮৮২-এ নেত্রকোণা। কিন্তু এরপরেও একদিকে যেমন ঠগী-ডাকাত-লুটেরাদের অত্যাচার বাড়তে থাকে অন্যদিকে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শাসকশ্রেণীর মধ্যেও দুর্নীতি ও চরিত্রহীনতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৭৯৩-এ প্রকাশ্যে মদ বিক্রির লাইসেন্স, ১৮০৬-এ কালেক্টর গ্রোসের তহবিল তছরুপ, ১৮১৬-এ আফিমের অনুপ্রবেশ সেইসাথে নীলকর ও তাদের দোসরদের অত্যাচার এবং জমিদারদের শোষণ মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে।

এছাড়া ১৭৯৭-এ আলু, ১৮০৬-এ নীল বা ১৮০৮-এ শণ চাষের আয়োজন একদিকে যেমন কৃষি অর্থনীতিকে পঙ্গু করে অন্যদিকে বাজিতপুরের মসলিন ও কিশোরগঞ্জের তজ্জাব বস্ত্রের মতো কুটির শিল্পও ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। যার ফলে ১৭৮৭-এ ডাক, ১৭৯১-এ চিকিৎসা, ১৮০০-এ নতুন মুদ্রা, ১৮০৬-এ রাস্তাঘাট, ১৮১৫-এ মুদ্রিত পুস্তক, ১৮৪৬-এ ইংরেজী স্কুল বা ১৮৫৩-এ সরকারী জিলা স্কুল স্থাপনেও সাধারণের তেমন কোন উন্নতি ঘটে নি। বরং দৃশ্যমান সুবিধাভোগের দ্বার উন্মুক্ত হয় মুষ্টিমেয় শাসকশ্রেণীর।

এরপরও ১৮৫৮-এর স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে প্রথমে পৌরসভা, ১৮৮৭-এ জেলা বোর্ড গঠন ও পরে মহকুমা সৃষ্টির পাশাপাশি ১৮৬৪-এ উচ্চশ্রেণীর মর্যাদায় অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট প্রথা, দেশীয় শাসক নিয়োগ, ১৮৭৭ থেকে জমিদার গংকে বিভিন্ন রাজকীয় উপাধি প্রদানের পালাও শুরু হয়। সেইসাথে ১৮৮০-এ মানি অর্ডার, ১৮৮১-এ প্রথম আদমশুমারী, ১৮৮৩-এ টেলিগ্রাফ, ১৮৮৬ ও ১৮৯৯-এ রেলপথ, ১৮৮৯-এ সূর্যকান্ত লাইব্রেরী, ১৮৯৩-এ রাজরাজেশ্বরী জলকল ইত্যাদি যুক্ত হয়ে উচ্চ-মধ্যবিত্তের নাগরিক সুবিধাই শুধু বৃদ্ধি পায়। সর্বসাধারণ যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই ডুবে যেতে থাকে।

তবু আশার আলো ছড়ায় ১৮৬৫-এর ‘লিটারেচার সভা’, ‘বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ ও ‘সৌরভ’ মাসিকপত্র বা ১৮৭৭-এর সারস্বত সমিতি। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০০-এ মন্মথ কলেজ ও ১৯০১-এ সিটি কলেজ। ফলে শিক্ষাদীক্ষার সাথে দেশীয় কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের প্রচার ও প্রসারের পথ হয় উন্মুক্ত। পাশাপাশি হিন্দু-মুসলিম সংঘাত ও খ্রিষ্টান মিশনারীদের তৎপরতায় অভ্যুদয় ঘটলো ব্রাহ্ম ধর্ম ও আহমদীয়া সম্প্রদায়ের। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হল ‘হিন্দু ধর্মজ্ঞান প্রদায়িনী সভা’ ও ‘আঞ্জুমানে ইসলামিয়া সমিতি’। ‘শ্রী’ এর বদলে ‘মোহাম্মদ’ লেখার রীতি চালু হওয়ার সাথে সাথে হানাফী-মোহাম্মদী ও সুন্নী-কাদিয়ানী কোন্দলও দেখা দিল।

এই ধর্মীয় অভিঘাতেই নানকার, ভাওয়ালী, টঙ্ক, তেভাগা, খড় প্রভৃতি আন্দোলন যথাযথ প্রসার লাভ করতে পারেনি। ম্লান হয়ে গেছে ঝলসে ওঠা ঈশাখাঁর তরবারি বা বীরাঙ্গনা সখিনার বীরত্ব। আর সাধারণ জনের ভাগ্যেরও তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। তবু নিখিল ভারত কৃষাণ সম্মিলন, প্রজা সমিতি বা ঋণসালিশী বোর্ডের জন্ম সাময়িক আশার আলো ছড়ায়। কিন্তু কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক বিভক্তিকেই লালন করতে থাকে। পরবর্তীতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ঊনসত্তুরের গণ অভ্যুত্থান ও একাত্তুরের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমস্ত ভেদবুদ্ধিকে দূর করে গড়ে তোলে স্বাধীন ও সমৃদ্ধ জনপদ ময়মনসিংহ।



তথ্য সূত্র : সংগৃহীত